২৫/১/১৯৬৬
সমীর
ডেরি-অন-সোনে আমার চোখের সামনে দিয়ে বম্বে মেল বেরিয়ে যায়। তখন আমাদের ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছোঁয়নি। পরবর্তী ট্রেন পাঠানকোট ভোর সাড়ে চারটের সময়। বসে বসে শীতে কাঁপবার বদলে একদল লোকের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিলুম। একজন রেলকর্মীর নামে স্টেশন মাস্টারের কাছে কমপ্লেন ইত্যাদি করতে-করতেই বেশ সময় কেটে গেল।
পাঠানকোট সারা রাস্তা লেট করতে লাগলো। একবার তো একটা বগি ছিঁড়ে বেরিয়েই গেল, পেছনের দিকে অবশ্য--- তাই নিয়ে হৈ চৈ মেরামত হলো--- আমার ট্রেন চলা--- অনবরত সাসপেন্স--- কখন ট্রেনটা কলকাতায় পৌঁছোবে। কারণ, আমি আগাগোড়াই ভাবছি--- সেদিন সন্ধের মধ্যে না পৌঁছুতে পারলে--- আমার আসাটাই ব্যর্থ; তাহলে তো আরো কয়েকদিন থেকে এলেই পারতুম। বর্ধমান এলো--- বিকেল পাঁচটায়--- আমি তখনও ছটফট করছি, ট্রেন তখনও থেমে থেমে চলছে, সাড়ে সাতটা আন্দাজ শিয়ালদা থেকে এক মাইল দূরে সিগনাল না পেয়ে ট্রেন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তখন সুটকেস হাতে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে অন্ধকার রেল লাইন ধরে ধরে ছুটে, বাঁধ দিয়ে গড়িয়ে নেমে-- নারিকেলডাঙা রোডে এসে উপস্হিত। সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে সোজা আনন্দবাজার। সে এক অ্যাডভেঞ্চার। ততক্ষণে আমাকে বিষম খোঁজাখুঁজি পড়ে গেছে।
এসবে কিন্তু মাথার একটুও ক্ষতি হয়নি। কারণ মন-মেজাজ বেশ প্রখর হয়েছিল। ক্রমশ দেখছি শান্ত জীবনের প্রতি আমার দুর্নিবার লোভ দেখা দিচ্ছে। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমি কোনোদিন সুবিধে করতে পারিনি। কিন্তু হনির সঙ্গে খেলা করতে আমার এমন ভালো লেগে গেল। আগে ছিল, সৌন্দর্য বা প্রকৃতি দেখলেই--- তাকে ধ্বংস করার প্রবল ইচ্ছে। এখন ভালো লাগছে, শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে। বেতলার ডাকবাংলোয় যে গিয়েছিলাম--- দু'এক বছর আগে হলে কি ব্র্যান্ডির বোতল নিতে কোনক্রমে ভুলে যেতুম বা শেষ পর্যন্ত মহুয়া জোগাড় না করে ছাড়তুম ? আরও কত কত গন্ডোগোলের সন্ধান করতুম কে জানে। এখন দেখছি, কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যেও একটা প্রবল উত্তেজনা আছে। নিজেকে পোষ মানানোও এক রকমের নেশা। এখন বেশ ভালো লাগছে কয়েকটা দিন। ঠিক করেছি, কলকাতার দলবলের সঙ্গে নয়, একা একা প্রায়ই দুচারদিনের জন্য কলকাতার বাইরে ঘুরে আসবো। তুই ওখানে অফিসের কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে কিছুটা হাল্কা হলে--- পরে আবার একবার যাবো। বেলা খুব ভালো মেয়ে--- বিয়ে করে সন্দীপনের মতো ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা তোর একটুও নেই। কলকাতার বিবাহিত বন্ধুদের দেখলে--- আমার বিয়ে করার শখ একেবারে উপে যায়।
কলকাতার গুরুতর খবর--- বিনয় মজুমদার এখন জেলে। কয়েকদিন আগে বিনয়ের পাগলামি একটু বেড়ে যায়। যে হোটেলে থাকতো--- সেই হোটেলের ঠাকুরকে ঘুমন্ত অবস্হায় লাঠি মেরে খুন করতে যায়। প্রথমে আমি শুনেছিলাম--- লোকটা খুনই হয়ে গেছে। এখন জানলুম, না, আঘাত খুব মারাত্মক নয়, বেঁচে উঠবে লোকটা। ফেব্রূয়ারিতে বিনয়ের কেস উঠবে--- এখন বিনয়ের জন্য কেউ জামিন হয়ে ছাড়াতে রাজি নয়। কারণ ছাড়িয়ে কোথায় রাখা হবে ? বিনয়ের দাদা ওর ভার নিতে অস্বীকার করেছেন। হাজতে বিনয়কে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখে খুব অদ্ভুত লাগলো। স্বাভাবিক হয়ে গেছে এখন। কৃত্তিবাসে একটা কবিতা ছাপার বিষয়ে কথা বললো। বিনয়ের তুলনায় আমরা কতো ছোটো। পৃথিবীতে দু'একজন মাত্রই থাকে -- যারা কবিতা ছাড়া আর সব কিছুই ভুলে যায়-- আর সব কিছুই তাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর। কৃত্তিবাসের জন্য তোর লেখা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিস।
সুনীল
( বেলা সমীর রায় চৌধুরীর স্ত্রী। হনি ওনার মেয়ে। সমীর এই সময়টিতে কৃত্তিবাস পত্রিকায় আর কবিতা দিচ্ছিলেন না; প্রধানত হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সুনীল ও কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের কার্যকলাপের জন্য । সমীরের গোচরে একথা এসেছিল যে আয়ওয়া থাকাকালে সেখান থেকে সুনীল তাঁর পরিচিত সবাইকে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ওসকাচ্ছিলেন । সন্দীপন, উৎপল, শক্তি, শরৎ প্রমুখকে লেখা চিঠিগুলি থেকে তার প্রমাণ মেলে ।
নিম্ন আদালতে সমীরের ছোটো ভাই মলয়ের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল । সমীরের ক্রোধ প্রশমিত করতে সুনীল গিয়েছিলেন ডালটনগঞ্জে । সমীর তাঁকে অফিসের জিপে চাপিয়ে একজন পিয়নের সঙ্গে ডেহরি অন সোন স্টেশানে ট্রেনে তুলে দেবার জন্য পাঠিয়েছিলেন । সুনীল এখানে সে কথাটি উহ্য রাখলেন । ধন্যবাদ জানাবার প্রয়োজন মনে করলেন না ।)
সমীর
ডেরি-অন-সোনে আমার চোখের সামনে দিয়ে বম্বে মেল বেরিয়ে যায়। তখন আমাদের ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছোঁয়নি। পরবর্তী ট্রেন পাঠানকোট ভোর সাড়ে চারটের সময়। বসে বসে শীতে কাঁপবার বদলে একদল লোকের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিলুম। একজন রেলকর্মীর নামে স্টেশন মাস্টারের কাছে কমপ্লেন ইত্যাদি করতে-করতেই বেশ সময় কেটে গেল।
পাঠানকোট সারা রাস্তা লেট করতে লাগলো। একবার তো একটা বগি ছিঁড়ে বেরিয়েই গেল, পেছনের দিকে অবশ্য--- তাই নিয়ে হৈ চৈ মেরামত হলো--- আমার ট্রেন চলা--- অনবরত সাসপেন্স--- কখন ট্রেনটা কলকাতায় পৌঁছোবে। কারণ, আমি আগাগোড়াই ভাবছি--- সেদিন সন্ধের মধ্যে না পৌঁছুতে পারলে--- আমার আসাটাই ব্যর্থ; তাহলে তো আরো কয়েকদিন থেকে এলেই পারতুম। বর্ধমান এলো--- বিকেল পাঁচটায়--- আমি তখনও ছটফট করছি, ট্রেন তখনও থেমে থেমে চলছে, সাড়ে সাতটা আন্দাজ শিয়ালদা থেকে এক মাইল দূরে সিগনাল না পেয়ে ট্রেন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তখন সুটকেস হাতে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে অন্ধকার রেল লাইন ধরে ধরে ছুটে, বাঁধ দিয়ে গড়িয়ে নেমে-- নারিকেলডাঙা রোডে এসে উপস্হিত। সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে সোজা আনন্দবাজার। সে এক অ্যাডভেঞ্চার। ততক্ষণে আমাকে বিষম খোঁজাখুঁজি পড়ে গেছে।
এসবে কিন্তু মাথার একটুও ক্ষতি হয়নি। কারণ মন-মেজাজ বেশ প্রখর হয়েছিল। ক্রমশ দেখছি শান্ত জীবনের প্রতি আমার দুর্নিবার লোভ দেখা দিচ্ছে। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমি কোনোদিন সুবিধে করতে পারিনি। কিন্তু হনির সঙ্গে খেলা করতে আমার এমন ভালো লেগে গেল। আগে ছিল, সৌন্দর্য বা প্রকৃতি দেখলেই--- তাকে ধ্বংস করার প্রবল ইচ্ছে। এখন ভালো লাগছে, শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে। বেতলার ডাকবাংলোয় যে গিয়েছিলাম--- দু'এক বছর আগে হলে কি ব্র্যান্ডির বোতল নিতে কোনক্রমে ভুলে যেতুম বা শেষ পর্যন্ত মহুয়া জোগাড় না করে ছাড়তুম ? আরও কত কত গন্ডোগোলের সন্ধান করতুম কে জানে। এখন দেখছি, কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যেও একটা প্রবল উত্তেজনা আছে। নিজেকে পোষ মানানোও এক রকমের নেশা। এখন বেশ ভালো লাগছে কয়েকটা দিন। ঠিক করেছি, কলকাতার দলবলের সঙ্গে নয়, একা একা প্রায়ই দুচারদিনের জন্য কলকাতার বাইরে ঘুরে আসবো। তুই ওখানে অফিসের কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে কিছুটা হাল্কা হলে--- পরে আবার একবার যাবো। বেলা খুব ভালো মেয়ে--- বিয়ে করে সন্দীপনের মতো ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা তোর একটুও নেই। কলকাতার বিবাহিত বন্ধুদের দেখলে--- আমার বিয়ে করার শখ একেবারে উপে যায়।
কলকাতার গুরুতর খবর--- বিনয় মজুমদার এখন জেলে। কয়েকদিন আগে বিনয়ের পাগলামি একটু বেড়ে যায়। যে হোটেলে থাকতো--- সেই হোটেলের ঠাকুরকে ঘুমন্ত অবস্হায় লাঠি মেরে খুন করতে যায়। প্রথমে আমি শুনেছিলাম--- লোকটা খুনই হয়ে গেছে। এখন জানলুম, না, আঘাত খুব মারাত্মক নয়, বেঁচে উঠবে লোকটা। ফেব্রূয়ারিতে বিনয়ের কেস উঠবে--- এখন বিনয়ের জন্য কেউ জামিন হয়ে ছাড়াতে রাজি নয়। কারণ ছাড়িয়ে কোথায় রাখা হবে ? বিনয়ের দাদা ওর ভার নিতে অস্বীকার করেছেন। হাজতে বিনয়কে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখে খুব অদ্ভুত লাগলো। স্বাভাবিক হয়ে গেছে এখন। কৃত্তিবাসে একটা কবিতা ছাপার বিষয়ে কথা বললো। বিনয়ের তুলনায় আমরা কতো ছোটো। পৃথিবীতে দু'একজন মাত্রই থাকে -- যারা কবিতা ছাড়া আর সব কিছুই ভুলে যায়-- আর সব কিছুই তাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর। কৃত্তিবাসের জন্য তোর লেখা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিস।
সুনীল
( বেলা সমীর রায় চৌধুরীর স্ত্রী। হনি ওনার মেয়ে। সমীর এই সময়টিতে কৃত্তিবাস পত্রিকায় আর কবিতা দিচ্ছিলেন না; প্রধানত হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সুনীল ও কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের কার্যকলাপের জন্য । সমীরের গোচরে একথা এসেছিল যে আয়ওয়া থাকাকালে সেখান থেকে সুনীল তাঁর পরিচিত সবাইকে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ওসকাচ্ছিলেন । সন্দীপন, উৎপল, শক্তি, শরৎ প্রমুখকে লেখা চিঠিগুলি থেকে তার প্রমাণ মেলে ।
নিম্ন আদালতে সমীরের ছোটো ভাই মলয়ের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল । সমীরের ক্রোধ প্রশমিত করতে সুনীল গিয়েছিলেন ডালটনগঞ্জে । সমীর তাঁকে অফিসের জিপে চাপিয়ে একজন পিয়নের সঙ্গে ডেহরি অন সোন স্টেশানে ট্রেনে তুলে দেবার জন্য পাঠিয়েছিলেন । সুনীল এখানে সে কথাটি উহ্য রাখলেন । ধন্যবাদ জানাবার প্রয়োজন মনে করলেন না ।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন