ষাটের দশকে চাইবাসার চালাঘরের উঠানে সমীর রায়চৌধুরী

ষাটের দশকে চাইবাসার চালাঘরের উঠানে সমীর রায়চৌধুরী

বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে

৩২/২ যোগী পাড়া রোড                                                                                                ৯/১১/১৯৬৫
কলকাতা ২৮
সমীর
        মলয়ের ৫ তারিখের মামলার বিস্তৃত বিবরণ নিশ্চয়ই ওদের চিঠিতে জানতে পারবি, বা জেনে গেছিস। সে-সম্পর্কে আর লিখলাম না।
        দুটি ব্যাপার দেখে কিছুটা অবাক ও আহত হয়েছি। তুই এবং মলয় ইত্যাদি ধরেই নিয়েছিলি আমি মলয়ের স্বপক্ষে সাক্ষী দেবো না --- বরং অন্যান্যদের বারণ করবো, কোনোরকম সাহায্য করবো না। তোর অনুরোধ ছিল, 'শেষ অনুরোধ' --- যেন আমি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বা চতুর্থ অনুরোধ আগে প্রত্যাখ্যান করেছি। মলয়ও কয়েকদিন আগে সকালে আমার বাড়িতে এসে বললো, ওর ধারণা আমি চারিদিক থেকে সঙ্গে শত্রুতা করছি এবং অপরকে ওর সঙ্গে সহযোগীতা করতে বারণ করছি।
        অপরপক্ষে, মামলার রিপোর্ট কাগজে বেরুবার পর --- কফি হাউসের কিছু অচেনা যুবা, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসে। আমি নাকি খুবই মহৎ ব্যক্তি--- হাংরি জেনারেশানের সঙ্গে কখনও যুক্ত না থেকেও এবং কখনো পছন্দ না করেও যে ওদের স্বপক্ষে সাক্ষী দিয়েছি --- সেটা নাকি আমার পক্ষে পরম উদারতার পরিচয় !
        ওদের ওই নকল উদারতার বোঝা, এবং তোদের অন্যায্য অবিশ্বাস --- দুটোই আমার কাছে হাস্যকর মনে হল। মানুষ কি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে ভুলে গেছে ? আমার ব্যবহার এপ্রসঙ্গে আগাগোড়া যা স্বাভাবিক তাই। আমার স্ট্যান্ড আমি অনেক আগেই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি। আমি হাংরি জেনারেশান পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে ), আমি ওদের কিছু কিছু পাজি ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি। মলয়ের দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না   --- আমার রুচি অনুযায়ী এই ধারণা। অপরপক্ষে, লেখার জন্য কোনো লেখককেই পুলিশের ধরার এক্তিয়ার নেই --- একথা আমি বহুবার মুখে এবং কৃত্তিবাসে লিখে জানিয়েছি। পুলিশের বিরুদ্ধে এবং যে-কোনো লেখকের স্বপক্ষে ( সে লেখকের শঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যাই হোক না ) দাঁড়ানো আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ বলেই মনে করি। কারুর লেখা আমি অপছন্দ করি বলেই তার শত্রুতা করবো, কিংবা অন্য কারুকে নিবৃত্ত করবো তাকে সাহায্য করতে --- এরকম নীচতা কি আমার ব্যবহারে বা লেখায় কখনো প্রকাশ পেয়েছে ? এসব ছেলেমানুষী চিন্তা দেখলে -- মাঝে মাঝে রাগের বদলে হাসিও পায়।
        যাই হোক, আদালতের সাক্ষ্যতে আমি দুটি কথা বলেছি। মলয়ের লেখার মধ্যে অশ্লীলতা কিছুই নেই --- এবং লেখাটা আমার ভালোই লেগেছে। ধর্ম সাক্ষী করে আমি দ্বিতীয় কথাটা মিথ্যে বলেছি। কারণ, কয়েকদিন আগে মলয় যখন আসে --- তখন আমি বলেছিলাম যে ওর লেখা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নটি জেনারাল, এবং সেই জেনারাল প্রশ্নে আমি অশ্লীলতা বলে কিছুই মানি না। সুতরাং সেই হিসেবে মলয়ের লেখাও যে কিছুমাত্র অশ্লীল নয় তা আমি সাক্ষীর মঞ্চে উঠে স্পষ্ট ভাবে বলতে রাজি আছি। তখন মলয় আমাকে অনুরোধ করে, আমি যদি ওকে সাহায্য করতে চাই, তবে জজসাহেবের সামনে ওর কবিতা আমার খারাপ লাগে এটাও যেন না বলি। আদালত তো আর সমালোচনার জায়গা নয়। বরং ওর কবিতা আমার ভালো লাগে বললেই নাকি কেসের সুবিধে হবে।
        সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়। পড়ে আমার গা রি রি করে। এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি --- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না --- এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না। মলয়ের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেই কবিতার চিহ্ণ নেই। মলয় যদি আমার ছোটো ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম । যাই হোক, তবু আমি  বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে। এর কারণ আমার কোনো মহত্ব নয় --- আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন । যে কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি --- সেই করণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি। যাই হোক, সেদিন আদালতে গিয়ে মনে হল, হাকিম এবং পুলিশপক্ষ এ মামলা ডিসমিস করে দিতে পারলে বাঁচে --- কিন্তু মলয়ের প্রগলভ উকিল ও মামলা বহুদিন ধরে টেনে নাম কিনতে চায়।
        ডিসেম্বরের ৮-৯ তারিখে পাটনায় আমেরিকান সাহিত্যের ওপর একটা সিম্পোসিয়াম হবে। আমি তাতে যোগদান করার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছি। ঐ সময় আমি পাটনা যাবো। আশা করি ভালো আছিস।
                                                                            সুনীল
( মলয় রায়চৌধুরীর যে কবিতাটির কথা সুনীল উল্লেখ করেছেন তা আজ একটি কিংবদন্তি কবিতা, 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' যা ইংরেজিতে 'স্টার্ক ইলেকট্রিক জিশাস' হিসাবে অনুদিত হবার পর পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সুনীল সম্ভবত ভবিষ্যতের বাংলা কবিতার বাঁকবদল অনুমান করতে পারেননি। মলয়ের এই কবিতাটিই উপমহাদেশের একমাত্র কবিতা যা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত 'মডার্ন অ্যান্ড পোস্টমডার্ন পোয়েট্রি অব দি মিলেনিয়াম' সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।  পরবর্তীকালে সুনীল যখন খ্যাতি লাভ করেন তখন থেকে তিনি সমীরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা আরম্ভ করেন এবং তাঁর সম্পাদিত কোনো কবিতা ও গল্প সংকলনে সমীরকে অন্তর্ভুক্ত করেননি ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে অনুরোধ করার পর তিনি সাক্ষ্য দিতে রাজি হন । কিন্তু তরুণ সান্যাল ও জ্যোতির্ময় দত্তকে অনুরোধ করতে হয়নি । তাঁরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে এসেছিলেন ।  উচ্চ আদালতে মামলা লড়ার জন্য জ্যোতির্ময় দত্ত একজন প্রখ্যাত ক্রিমিনাল লয়ারের কাছে মলয়ের কেসটি নিয়ে গিয়েছিলেন ।
এখানে একথাও জেনে রাখা প্রয়োজন যে শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেছিলেন । ) 

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চিঠিতে ঠিকানা ও তারিখ নেই
ডাক ঘরের ছাপ থেকেও বোঝা যাচ্ছে না
সমীর,
        এই মাত্র তোর টেলিগ্রাম পেলুমকী যে সাহেব হয়েছিস । টেলিগ্রামের বদলে চিঠি লিখলে বেলার খবরও জানতে পারতুম; বেলা এবং তোদের নতুন সন্তান কেমন আছে ?
        স্বাতী নার্সিং হোম থেকে ওদের বাড়িতে ফিরে গেছে, ভালো আছে--- ক্রমশ ভালো হয়ে উঠছে। এখন ছেলের নাম নিয়ে জল্পনা চলছে, আমি তার থেকে অনেক দূরে আছি --- নাম নিয়ে আমার একদম ভাবতে ইচ্ছে করে না। নতুন পিতৃত্বের ফলে আমার মধ্যে হঠাৎ খুব অস্বস্তি জেগেছে, খালি মনে হচ্ছে কোথাও বাইরে কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসি --- কোথাও গিয়ে দারুণ গন্ডোগোল করি, অনেক কিছু ভেঙে চুরমার করি, অন্তত বিপুল মদ্যপান করে বেশ কয়েকদিন অজ্ঞান হয়ে থাকি। স্বাতী খুশি হয়েছে, সেই জন্য আমিও খুশী, সে খুশীতে ভেজাল নেই, কিন্তু অস্বস্তিটাও সত্যি, ছটফটানিটাও সত্যি, দেখা যাক। তোর গল্পটা আমার খুব ভালো লেগেছে। ঐ গল্পটা আমি আগেও তোর মুখে শুনেছিলুম; কিংবা আমেরিকায় থাকার সময়ে আমায় সংক্ষেপে লিখেছিলি --- ব্যাপারটা সত্যি ভালো। যাই হোক, কিন্তু ও-গল্প এখন কৃত্তিবাসে ছাপা যাবে না  -- কেন না, কৃত্তিবাস বহুদিন বেরোয়নি --- জানুয়ারি মাস নাগাদ একটা বার করা যায় কিনা দেখিস, সেটা হবে ২৫ নং সংকলন --- সুতরাং সেটাতে শুধু কবিতাই থাকবে --- সম্ভবত কৃত্তিবাসের ঐটাই শেষ সংখ্যা। গল্পটা এখন থাক, তুই কয়েকটা কবিতা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দে।
                                                                                সুনীল

( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতা ও গল্পের বহু সংকলন সম্পাদনা করেছেন কিন্তু সমীর রায়চৌধুরীর লেখা সেগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করেননি। সমীর বোধ হয় সুনীলের চরিত্রে পরিবর্তনের আঁচ পেয়ে চিঠির বদলে তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠানো আরম্ভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সুনীল সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছেন সমীরকে। তার কারণ হয়তো সমীর হাংরি আন্দোলনের একজন স্রষ্টাদের অন্যতম ছিলেন বলে )

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যোগীপাড়া রোড
কলকাতা ২৮
৩০ আগস্ট  ১৯৬৬
সমীর
        টেলিগ্রামে কবিতার কথা জানতে চেয়েছিস --- এটা ভারী ভালো লাগলো। টেলিগ্রামের কাগজটা দেখতে হঠাৎ ভালো হয়ে গেছে এজন্য। আমি অবশ্য, কবিতা থেকে এখন কিছুটা দূরে। 
        আমি এখন দুটি ব্যাপারে ব্যস্ত, এক, স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি বালিকার সঙ্গে আমি সম্প্রতি প্রণয়াবদ্ধ হয়েছি। বেশ সুন্দরভাবে সরল ও যুবকোচিত হয়ে গিয়ে প্রেম করতে আমার চমৎকার লাগছে। মেয়েটি খুব নম্র ও লাজুক, অসম্ভব সৎ, ছোটো খাটো চেহারা, আমার চোখে তো খুবই সুন্দরী, অন্যরাও ওকে সুন্দরী বলে। ওর সঙ্গে আলাপ খুব রোমান্টিকভাবে। মেয়েটি আমার কবিতা পড়ে আমাকে চিঠি লিখতো বছর খানেক ধরে; মাস চারেক আগে এক দিন আমার বাড়িতে দেখা করতে আসে --- সেদিন নাম বলেনি। পরে, অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশান করাতে গিয়ে মেয়েটি আমাকে হাসপাতাল থেকে আবার চিঠি লেখে। আমি সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলাম, এরপর আর তিনচার বার দেখা হবার পরই -- তখনও আমি মেয়েটিকে একবার চুম্বন পর্যন্ত করিনি --- ও জানায় আমাকে ছাড়া ও আর কারুকে বিয়ে করবে না। আমি ব্যাপারটাতে অভিভূত হয়ে যাই, কারণ, ওকে বিয়ে করতে পারা --- আমার অশেষ সৌভাগ্য --- ওকে আমার এতই ভালো লেগেছে। অন্যান্য ঘটনা পরে জানাবো --- যাই হোক, আমি এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই, নিশ্চিত বিয়ে করবো, কিন্তু আপাতত একটা অসুবিধে দেখা দিয়েছে। মেয়েটির বাড়ি থেকে খুবই আপত্তি, --- শোনা যাচ্ছে ওর পরিবার কিছুটা ধনী, আমার মতো লক্ষ্মীছাড়ার সঙ্গে কিছুতেই ওঁরা বিয়ে দিতে চান না, কোন এক বিলেত-ফেরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে নাকি বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছে ইত্যাদি। মেয়েটিকে বাড়িতে এখন আটকে রাখছে --- আমার সঙ্গে দেখা করতে দিতে চায় না, তবু দেখা হয় অবশ্য। যাই হোক আমাকে পোস্টকার্ডে লেখা কোনো চিঠিতে তুই এব্যাপারে উল্লেখ করিস না।
        দ্বিতীয় ব্যাপারটা এই আমাকে এবার 'দেশ' পূজা সংখ্যার জন্য একটা উপন্যাস লিখতে বলেছে। এটা অন্যান্য লেখকদের কাছে খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার হলেও আপাতত আমার কাছে এক বিষম ঝঞ্ঝাট। মাসে মাত্র ৪০০ টাকা উপার্জনের জন্য আমাকে এখন এত লিখতে হয় যে আমি বিষম ক্লান্ত --- হঠাৎ সেগুলি চালিয়ে গিয়েও আবার একটা উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমি প্রায় exhausted  হয়ে গেছি। মাথার গোলমাল হবার উপক্রম। উপন্যাসের অর্ধেকটা লিখে দিয়ে দিয়েছি --- বাকি অর্ধেক কিছুই মাথায় আসছে না অথচ, আর দিন দশেকের মধ্যে না দিলে খুন করে ফেলবে। যাই হোক, এই সব ব্যাপারের জন্য আমি 'কৃত্তিবাস' থেকে এক সংখ্যা ছুটি নিয়েছি। আগামী সংখ্যা শরৎ একা সম্পূর্ণভাবে সম্পাদনা করছে, অক্টোবরে বেরুবে। তুই কৃত্তিবাসের জন্য অবিলম্বে লেখা পাঠিয়ে দে।
        হনি, বেলা আর তুই ভালো আছিস তো ।
                                                                     সুনীল 
( তাঁর উপন্যাস 'অরণ্যের দিনরাত্রী'র পটভূমি চাইবাসায় সমীরের বাসায় একত্রিত সহযোগী সাহিত্যিকগণ হলেও, সুনীল চিরকাল চাইবাসা প্রসঙ্গে এড়িয়ে গেছেন । চাইবাসায় সমীরের বাসায় তিনি বারবার যেতেন । তাঁর বিখ্যাত চরিত্র 'সন্তু' সমীরের শ্যালক, এবং 'কাকাবাবু' সমীরের খুড়শ্বশুর । সুনীল কোথাএগুলি উল্লেখ করেননি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় সমীরের চাইবাসার বাসায় দুই বছর ছিলেন । )

অধ্যাপক প্রবাল দাশগুপ্ত

সেন্টার ফর এ.ল. টি. এস.                                                                                   ৩ মার্চ ১৯৯৩
হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়
হায়দ্রাবাদ
৫০০ ১৩৪

সমীরবাবু
আপনার ৩০.১, ১০.২, ১৭.২ আর ২৬.২ এর পোস্টকার্ড এসেছে, তবে যথাক্রমে আসেনি। যাই হোক 'হাওয়া ৪৯' পেয়েই প্রাপ্তি স্বীকার করেছিলাম, আশা করি সেটা শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আর পোস্টমডার্ন ( অধুনান্তিক ) বিষয়ক লেখা অন্য কাজের ফাঁকে-ফাঁকে লিখছি। এখনই শেষ করা শক্ত, কিন্তু জুনের মধ্যে পাঠাতে পারব ; অর্থাৎ পূজা সংখ্যার জন্যে কথা দিতে পারছি। আশা করি আপনারা ভালো আছেন।
                                                                     প্রীতি ও শ্রদ্ধাসহ
                                                                   প্রবাল দাশগুপ্ত
( হাওয়া ৪৯ পত্রিকায় প্রকাশিত উপরোক্ত প্রবন্ধটিতে বহুভাষাবিদ অধ্যাপক প্রবাল দাশগুপ্ত অধুনান্তিক শব্দটিকে ভারতের প্রেক্ষিতে পোস্টমডার্ন অভিধাটির বাংলা প্রতিশব্দরূপে সর্বপ্রথম প্রয়োগ করে ছিলেন )

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর স্ত্রী )

প্রযত্নে: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩২/২ যোগীপাড়া রোড
কলকাতা ২৮
প্রিয় বেলা ও সমীর
        দেরীতে চিঠি দিচ্ছি বলে রাগ কোর না; এখানে কোনো কিছু কাজ করি না, বলেই একটুও সময় পাই না। রুটিন থাকলেই বরং সব কিছু করার সময় পাওয়া যায়।
        তোমরা এখন বোধহয় চাঁইবাসা, পাটনা ঘুরে ওখানে ফিরে গেছ। হনির খবর কি ? শরীর একটু ভাল আছে, খাওয়া-দাওয়া করছে এখন ? ওখানে বৃষ্টি হয়েছিল কি ? এখানে এসেই যদিও খুব গরম পেয়েছিলাম, এখন কিন্তু ভাল, দু-তিন দিন বৃষ্টি হয়ে ঠান্ডা পড়েছে বেশ। একটা অবশ্য বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটেছে; খুব বৃষ্টি হবার পরদিনই কোকিল ডাকছে। একেবারে অরসিক কোকিলটা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের এপারে মুখর হোল, গানটা শোনেনি।
        আমরা কিন্তু শীতকালে আবার যাচ্ছি। নেমন্তন্নর কথাটা ভুলো না। আর ভুললেই বা কি ? মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেব তোমাদের।
        ভাল তো সবাই ?
        অনেক ভালবাসা জেনো।
                                                                             স্বাতী
পু: নাম এখনো বেশি যোগাড় করে উঠতে পারিনি। পারলেই পাঠাবো।
( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রীর নাম স্বাতী। চিঠিটিতে তারিখ নেই। ডাক দপতরের ছাপ থেকেও স্পষ্ট নয়। সমীর যখন ডালটনগঞ্জ, পালামৌতে ছিলেন, সে-সময়ে লেখা )

রবি বর্মা

যুগপ্রভাত
মাতৃভূমি বিল্ডিংস
কালিকট, কেরল
৬/৭/১৯৬৬
প্রিয় সমীর
        "আমার ভিয়েৎনাম" প্রাপ্ত। ধন্যবাদ। নির্মম বক্তব্য ও নিছক যথার্থতাবোধ কবিতার পংক্তি-পংক্তিতে। আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। 
                                                                       স্নেহপূর্বক
                                                                          রবি বর্মা
( চিঠিটি মালায়ালমভাষী চিত্রশিল্পী বাংলাতেই লিখেছিলেন )

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

উৎপলকুমার বসু

২৩/১/১৯৭৭

লন্ডন
প্রিয় সমীর
        তোমার চিঠি পেলাম। আরো অনেককে বাড়ির ব্যাপারে লিখেছি। তোমার কাছ থেকেই প্রথম আশাপ্রদ উত্তর পাওয়া গেল।
        তুমি অবিলম্বে তোমার বাঁশদ্রোণীর বাড়ির ঠিকানা আমাকে জানিও। সান্ত্বনার দিদি টালিগঞ্জে থাকেন। তিনি ঘুরে দেখে আসতে পারেন। এসি বিদ্যুৎ কিনা অবশ্যই জানিও।
        আমরা লন্ডন থেকে ফেব্রূয়ারির শেষ দিকে বা মার্চ মাসে কলকাতায় পৌঁছব। প্রথম দু'এক দিন হয়ত সান্ত্বনার দিদির বাড়িতে কাটবে। তারপর থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের ঘরবাড়ির জিনিষপত্র জাহাজে কলকাতায় পৌঁছে যাবে আশা করা যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহে এই সব জিনিষ রওনা হচ্ছে। এখন তুমুল বেগে গোছানো এবং লিস্ট করা চলছে। বহুদিন এদেশে থাকলাম --- প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় প্রচুর জিনিষপত্র জমেছে। রাশিকৃত বই কাগজ হাড়ি বাসন বাক্স-ট্রাঙ্কের জঙ্গলে বসে এই চিঠি লিখছি।
        আজ এই পর্যন্ত। অদূর ভবিষ্যতে দেখা হবে নিশ্চই।
                                                                                 ইতি
                                                                              উৎপল
          

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

১৭/১২/১৯৬৫
সমীর,
          আজ শুক্রবার বিকেলে, আজ রাত্তিরের ট্রেনে৪ দুমকা চলে যেতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে--কিন্তু জানি যাওয়া হবে না। যেতে পারবো না। কেন যেতে পারবো না--- সে সব কাজের তালিকা দিয়ে লাভ নেই। ছোট ছোট কাজের সঙ্গে নানা জনের সম্পর্ক---চলে গেলে সবাই ভুল বুঝবে। একজনের কবিতার বইয়ের মলাট আঁকবার জন্য যে পূর্ণেন্দুর বাড়িতে যাবো বলেছিলাম--- সেই সামান্য কাজটাও বন্ধ করে দেবার শক্তিন আমার নেই।, ভুল বুঝবে---হয়তো ভাববে, আমি তার কবিতার বইটা গ্রাহ্য করছি না। এমন দুর্বল হয়ে পঢ়েছি। অথচ সবাইকে তো বলতে পারি না--- আমাকে ছেড়ে দাও, নইলে আমি পাগল হয়ে যাবো। অথচ আমার অবস্হা সত্যিই এরকম। সবকিছু ছেড়েছুড়ে একটা ছোটখাট বিয়ে করে যদি শান্তভাবে কিছুদিন না কাটাতে পারি-- তবে সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে যাবো। প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা এমন ক্লান্ত বোধ করি।

          দুমকায় এবার আর যাওয়া হল না। সামনের শুক্রবারে তো তুই আর থাকবি না। যাই হোক ডালটনগঞ্জে সংসার গুছিয়ে বসা মাত্র আমায় জানাবি--- আমি যেতে চাই। বেলার সঙ্গে আগে কখনো ভালো করে কথা বলা হয়নি। এবার অনেক গল্প করলুম। ওর মতো শান্ত অথচ দৃঢ় এবং বুদ্ধিমতী মেয়েকে তুই কাছে পেয়েছিস--- তুই নিশ্চিত ভাগ্যবান। হনি এত সুন্দর।

          পাটনা শহরের হয়তো আলাদা কোনো গুণ নেই--- কিন্তু ওখানে গিয়ে আমার মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত শেষ দুদিন। বোধহয় ওখানে আমি আরও দশদিন থেকে যেতে পারতাম। রেনুজী তো একটি আবিষ্কার--- আমি কল্পনাই করতে পারিনি।

        আমার ওপর তোর কি এখনও রাগ আছে বা অভিমান ? আমার কিছুই মনে নেই। কেন রাগ কিসের অভিমান ? আমি যত ভুল করেছি--- সব কিছুর জন্য ক্ষমা কর। আমি অসহায়। আমি জড়িয়ে গেছি এক বিষম চক্রান্তে। মদ খাওয়া, হৈ হৈ সব কিছু ছেড়ে--- কিছুদিন কি সুস্হ ভাবে বাঁচতে পারবো ? আধুনিক সাহিত্যিক হবার এসব বিড়ম্বনা আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। আমি পাগল হয়ে যেতে চাই না, মরে যেতে চাই না। আমার অবস্হা এখন খুব খারাপ। আমি আর কিছুদিন সুস্হভাবে বাঁচতে চাই--- যদি হাঁটু গেড়ে দুহাত শিকল বেঁধে বাঁচতে হয় তবুও। যদি কবিতা লিখে থাকিস কৃত্তিবাসের জন্য পাঠিয়ে দিস। আমার কবিতার বইটা আমি তোর নামে উৎসর্গ করতে চাই--- তোর কি কোনো আপত্তি আছে ? আপত্তি থাকলে খোলাখুলি জানাস । মনে হচ্ছে, এই চিঠিটা লেখার সময় আমি অক্ষরগুলো চোখে দেখতে পাচ্ছি না।
                                                                             সুনীল 
( সুনীলের প্রথম কাব্যগ্রন্হ 'একা এবং কয়েকজন' সমীর রায়চৌধুরী তাঁর প্রথম মাইনের টাকা থেকে প্রকাশ করেছিলেন । এই গ্রন্হটি সমীরের অনুমতি ব্যতিরেকে অন্যান্য প্রকাশকরা প্রকাশ করেছেন , যা অন্যায় ও বেআইনি । সুনীল নিজেও সমীরের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন মনে করেননি । 
সমীরই সুনীলের একমাত্র বন্ধু ছিলে; তুইতোকারির সম্পর্ক ছিল । সুনীল মানুষটির তোষামোদকারী ছিল বহু, কিন্তু প্রকৃত বন্ধু কেউই ছিল না । কিন্তু হাংরি জেনারেশান আন্দোলনে তাঁর পরিবর্তে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নেতৃত্বে বসানোয় তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হনআজীবন সেই ক্ষোভ তিনি বহন করেছেন । বিদেশে যখন তাঁকেও হাংরি আন্দোলনকারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি তার প্রতিবাদ করেননি । সেকারণে তাঁর মৃত্যুর পর বিদেশের প্রায় প্রতিটি মিডিয়ায় তাঁকে 'হাংরিয়ালিস্ট' রূপে উল্লেখ করা হয়েছে । )