ষাটের দশকে চাইবাসার চালাঘরের উঠানে সমীর রায়চৌধুরী

ষাটের দশকে চাইবাসার চালাঘরের উঠানে সমীর রায়চৌধুরী

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

১৭/১২/১৯৬৫
সমীর,
          আজ শুক্রবার বিকেলে, আজ রাত্তিরের ট্রেনে৪ দুমকা চলে যেতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে--কিন্তু জানি যাওয়া হবে না। যেতে পারবো না। কেন যেতে পারবো না--- সে সব কাজের তালিকা দিয়ে লাভ নেই। ছোট ছোট কাজের সঙ্গে নানা জনের সম্পর্ক---চলে গেলে সবাই ভুল বুঝবে। একজনের কবিতার বইয়ের মলাট আঁকবার জন্য যে পূর্ণেন্দুর বাড়িতে যাবো বলেছিলাম--- সেই সামান্য কাজটাও বন্ধ করে দেবার শক্তিন আমার নেই।, ভুল বুঝবে---হয়তো ভাববে, আমি তার কবিতার বইটা গ্রাহ্য করছি না। এমন দুর্বল হয়ে পঢ়েছি। অথচ সবাইকে তো বলতে পারি না--- আমাকে ছেড়ে দাও, নইলে আমি পাগল হয়ে যাবো। অথচ আমার অবস্হা সত্যিই এরকম। সবকিছু ছেড়েছুড়ে একটা ছোটখাট বিয়ে করে যদি শান্তভাবে কিছুদিন না কাটাতে পারি-- তবে সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে যাবো। প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা এমন ক্লান্ত বোধ করি।

          দুমকায় এবার আর যাওয়া হল না। সামনের শুক্রবারে তো তুই আর থাকবি না। যাই হোক ডালটনগঞ্জে সংসার গুছিয়ে বসা মাত্র আমায় জানাবি--- আমি যেতে চাই। বেলার সঙ্গে আগে কখনো ভালো করে কথা বলা হয়নি। এবার অনেক গল্প করলুম। ওর মতো শান্ত অথচ দৃঢ় এবং বুদ্ধিমতী মেয়েকে তুই কাছে পেয়েছিস--- তুই নিশ্চিত ভাগ্যবান। হনি এত সুন্দর।

          পাটনা শহরের হয়তো আলাদা কোনো গুণ নেই--- কিন্তু ওখানে গিয়ে আমার মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত শেষ দুদিন। বোধহয় ওখানে আমি আরও দশদিন থেকে যেতে পারতাম। রেনুজী তো একটি আবিষ্কার--- আমি কল্পনাই করতে পারিনি।

        আমার ওপর তোর কি এখনও রাগ আছে বা অভিমান ? আমার কিছুই মনে নেই। কেন রাগ কিসের অভিমান ? আমি যত ভুল করেছি--- সব কিছুর জন্য ক্ষমা কর। আমি অসহায়। আমি জড়িয়ে গেছি এক বিষম চক্রান্তে। মদ খাওয়া, হৈ হৈ সব কিছু ছেড়ে--- কিছুদিন কি সুস্হ ভাবে বাঁচতে পারবো ? আধুনিক সাহিত্যিক হবার এসব বিড়ম্বনা আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। আমি পাগল হয়ে যেতে চাই না, মরে যেতে চাই না। আমার অবস্হা এখন খুব খারাপ। আমি আর কিছুদিন সুস্হভাবে বাঁচতে চাই--- যদি হাঁটু গেড়ে দুহাত শিকল বেঁধে বাঁচতে হয় তবুও। যদি কবিতা লিখে থাকিস কৃত্তিবাসের জন্য পাঠিয়ে দিস। আমার কবিতার বইটা আমি তোর নামে উৎসর্গ করতে চাই--- তোর কি কোনো আপত্তি আছে ? আপত্তি থাকলে খোলাখুলি জানাস । মনে হচ্ছে, এই চিঠিটা লেখার সময় আমি অক্ষরগুলো চোখে দেখতে পাচ্ছি না।
                                                                             সুনীল 
( সুনীলের প্রথম কাব্যগ্রন্হ 'একা এবং কয়েকজন' সমীর রায়চৌধুরী তাঁর প্রথম মাইনের টাকা থেকে প্রকাশ করেছিলেন । এই গ্রন্হটি সমীরের অনুমতি ব্যতিরেকে অন্যান্য প্রকাশকরা প্রকাশ করেছেন , যা অন্যায় ও বেআইনি । সুনীল নিজেও সমীরের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন মনে করেননি । 
সমীরই সুনীলের একমাত্র বন্ধু ছিলে; তুইতোকারির সম্পর্ক ছিল । সুনীল মানুষটির তোষামোদকারী ছিল বহু, কিন্তু প্রকৃত বন্ধু কেউই ছিল না । কিন্তু হাংরি জেনারেশান আন্দোলনে তাঁর পরিবর্তে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নেতৃত্বে বসানোয় তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হনআজীবন সেই ক্ষোভ তিনি বহন করেছেন । বিদেশে যখন তাঁকেও হাংরি আন্দোলনকারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি তার প্রতিবাদ করেননি । সেকারণে তাঁর মৃত্যুর পর বিদেশের প্রায় প্রতিটি মিডিয়ায় তাঁকে 'হাংরিয়ালিস্ট' রূপে উল্লেখ করা হয়েছে । ) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন